ট্রাকের হেলপার থেকে তিনি এখন বিসিএস ক্যাডার!

২০০৫ সাল।  এসএসসি রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে।  ছেলেটি তাঁর রেজাল্ট জানতে পারেনি।  সেদিন ছেলেটি ট্রাকের হেলপার হিসেবে ট্রাকের সঙ্গে মালামাল পরিবহনে অনেক দূরে ছিল।  পরদিন বাড়ি এসে ছেলেটি জানল কী বিস্ময় তাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিল
! সে পুরো কুড়িগ্রাম জেলায় মানবিক বিভাগ থেকে সেবার একমাত্র জিপিএ ফাইভ পেয়েছে।  জিপিএ ফাইভ তখনও দেশে মুড়িমুড়কির মত সহজলভ্য হয়নি!

সংগীত শিল্পী কনক চাঁপা এই অদম্য মেধাবী ছেলেটির এমন চমকপ্রদ ফলাফলের সংবাদ শুনে 

তাকে সাত হাজার টাকা  

 শুভেচ্ছা হিসেবে পাঠিয়েছিলেন।  বিভিন্ন বৃত্তি পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সেই ছেলেটি ২০০৭-০৮ সেশনে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পেছনে আরও অনেক করুণ গল্প আছে।  সে গল্পে আলোকপাত না করলে বড্ড সরলীকরণ হয়ে যাবে অসহনীয় সংগ্রামে ভরা এক জীবনের। 

ছেলেটি নিজেই বলেছে কুড়িগ্রাম জেলার দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে যার নিয়তি ছিল বাবা আব্দুল খালেকের মত জলিল বিড়ির ফ্যাক্টরিতে কাজ করার।  কিন্তু বিড়ির ধোঁয়ায় ঝাপসা আর নিয়ত ক্ষয়িষ্ণু জীবনের চেনা ঘানি সন্তানকে দিয়ে টানাতে চান নি বিড়ি শ্রমিক আব্দুল খালেক।  চান নি ছেলেটিও তার এই পেশায় আসুক। 

চেয়েছিলেন ছেলে তাঁর পড়াশোনা করে অফিসার হোক।  স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।  'গরীবের ঘোড়ারোগ' দেখে আশেপাশের মানুষের অবহেলা আর তাচ্ছিল্যও তাকে সইতে হল।  ক্লাস সিক্সে উঠার পর স্কুলের বেতন না দিতে পেরে ছেলেটির স্কুল ছাড়ার উপক্রম হল।  এগিয়ে এলেন একজন মহানুভব শিক্ষক; মোজাফফর স্যার! তিনি নিজে ছেলেটির বেতন দিলেন।  পরবর্তীতে স্কুলে বিনাবেতনে পড়াশোনা করার ব্যবস্থাও করে দেন। 

ছেলেটি অকপটে স্বীকার করেছে এক জোড়া প্যান্ট শার্ট দিয়ে পুরো স্কুল জীবন পার করতে হয়েছিল।  স্কুলে একবার নিয়ম করা হলো পায়ে জুতো ছাড়া কেউ স্কুলে আসতে পারবে না।  অনন্যোপায় ছেলেটি স্কুলে গেল উদোম পায়ে।  বসল সবার পেছনে যাতে শিক্ষকের নজরে না পড়ে।  শিক্ষক রণহুঙ্কারে ঘোষণা করলেন আজও যারা জুতো ছাড়া এসেছে তারা যেন ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়।  আর যারা পরদিন জুতো পরে আসতে পারবে না তাদের স্কুলে আসার দরকার নেই।  পরদিন কেউ আর মিস করবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে কজন আনেনি তারা রক্ষা পায়।  কিন্তু পেছনে বসা ছেলেটি অঝোরধারায় কাঁদতে থাকে।  জানে আজই তাঁর স্কুলে আসার শেষ দিন।  কেননা, তাঁর জন্য একজোড়া জুতো কেনা আর মহাকাশে চন্দ্রাভিযানের স্বপ্ন একই। 

না, ছেলেটিকে সে দফায় স্কুল ছাড়তে হয়নি।  ছেলেটির অসহায় কান্না দেখে সেদিন ক্লাসের সবাই মিলে এক জোড়া জুতো কেনার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছেলেটি বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে হলে উঠে।  সেখানে শুরু হয় আরেক নতুন জীবন।  সহস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আরেক নতুন সংগ্রাম।  অভাবিত অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাঁকে।  অবশ্য, তাঁর কাছে তখন আর কিছুই অভাবনীয় নয়; অসহনীয় নয়। 

নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে ছেলেটি ঢাকা শহরে লিফলেট বিলি করেছে, কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করেছে।  প্রতিদিন দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকাই যার কাছে ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ।  সে সংগ্রামে পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ আরও অনেকে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ছেলেটি বিসিএসের ভাইভা দেবে।  আবারও সেই স্কুলের জুতো কাহিনী।  যেন অপমানের নিয়তি তাঁর পেছন ছাড়ে না।  ভাইভার জন্য ফরমাল কোন ড্রেস নেই।  এক জুড়ো জুতো, প্যান্ট ও শার্ট লাগবে।  পরিচিত সামর্থ্যবান একজনের কাছে এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে দেয়ার জন্য ছেলেটি সাহায্য চেয়েছিল।  সাহায্য দূরে থাক উল্টো তাকে চরম অপমান সইতে হয়েছিল সেদিন। 

সেই ছেলেটি ৩৫তম বিসিএসের ভাইভা দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়েছে এবার।  অদম্য সংগ্রামী এক জীবনের অধিকারী এই ছেলেটির নাম মো. শফিকুল ইসলাম। 

কুড়িগ্রাম জেলা সদরের পলাশবাড়ির চকিদার পাড়ায় তাদের বাসা।  পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শফিকুল পরিবারের চতুর্থ সন্তান। 

এক সময়ের ট্রাকের হেলপার ছেলেটি এখন নিজ জেলার পাশের জেলা লালমনিরহাট সরকারি মজিদা খাতুন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার।  তাঁর এই সংগ্রামের পথচলায় যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তাদের কৃতজ্ঞচিত্তে সে স্মরণ করেছে।  সে তালিকায় আছেন পাশের বাড়ির মাহবুবুর রহমান লিটন চাচা, ডলার ভাই, ব্যাংকার মোজাহেদুল ইসলাম শামীম ভাই, মুক্তি আর্ট, বানিয়া পাড়ার লাবলু স্যার, কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মোজাফফর স্যার, মান্নান স্যার, মমতাজ ম্যাডামসহ আরো অনেক শিক্ষক।  আছেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জামাল স্যার, সা’দ উদ্দীন স্যার প্রমুখ। 

মো. শফিকুল ইসলাম জানান, মে মাসের দুই তারিখে চাকরিতে জয়েন করার আগে বাড়ি যাই।  রাতে খাবার খেতে বসে দেখে ঘরের চালের ফুটো দিয়ে ভাতের থালায় জোছনার আলো ফিনকি দিয়ে নামে।  চালের ফুটো দিয়ে আসা এ আলোকে এখন তিনি দেখছেন অনুপ্রেরণা হিসেবে। 


আসছে মাসের বেতনের টাকা দিয়ে ঘরের চাল ঠিক করবেন তিনি।  আকাশ থেকে নামা আলোরধারা পুরো সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে বলে জানান শফিকুল ইসলাম। 

0 Comment "ট্রাকের হেলপার থেকে তিনি এখন বিসিএস ক্যাডার!"

Post a Comment