সাকিব-মুস্তাফিজের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিবে বিসিবি ?

কলকাতা নাইট রাইডার্স এবারের আসরে পাঁচটি ম্যাচ ইতিমধ্যে খেলে ফেলেছে। কিন্তু দলের সাথে থাকার পরও এখন পর্যন্ত একটি ম্যাচেও প্লেয়িং ইলেভেনে জায়গা হয়নি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার
সাকিব আল হাসানের। হ্যাঁ, সেই সাকিব আল হাসান,

যিনি সদ্যই শ্রীলংকার বিপক্ষে ১-১ এ ড্র করা টেস্ট সিরিজের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন, নায়ক ছিলেন শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জয়েরও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বরাবরের মতই সেরা সময় কাটাতে থাকা খেলোয়াড়টি একটি ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি আসরে গিয়ে বেঞ্চ গরম করছেন। এর চেয়ে পরিহাসের বিষয় আর কি হতে পারে?

কেন দলে জায়গা হচ্ছে না সাকিবের? কারণটা আধুনিক ক্রিকেটের একটি বহুল চর্চিত টার্ম – টিম কম্বিনেশন। আইপিএলে এক দলে সর্বোচ্চ চার জন বিদেশী খেলানো যায়। কিন্তু টিম কম্বিনেশনের খাতিরে গৌতম গম্ভীরের দল সেই চারজন বিদেশীর তালিকায় সাকিবকে রাখতে পারছে না। ফলে ম্যাচের পর ম্যাচ মাঠের বাইরে বসেই বাকি সতীর্থদের খেলা দেখে যেতে হচ্ছে সাকিবকে।

অথচ সামনেই আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ এবং চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। এই সময়ে ম্যাচ প্রাকটিসের মধ্যে থাকাটা সাকিবের জন্য কতই না জরুরি ছিল। কিন্তু সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি। কিন্তু এই একই সময়ে তার জাতীয় দলের অধিকাংশ সতীর্থরা ব্যস্ত ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগ (ডিপিএল)-এ খেলতে। এবং ডিপিএল হলো ৫০ ওভার ফরম্যাটের টুর্নামেন্ট। তাই এখানে খেলে যে মুশফিক-মাশরাফি-তামিমরা ত্রিদেশীয় সিরিজ ও চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আগে নিজেদের বেশ ভালোভাবেই ঝালিয়ে নিতে পারছেন সে কথা তো বলাই বাহুল্য।

অথচ মুদ্রার অপর পিঠে সাকিবকে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে। অনেকে বলতে পারেন, সাকিব আইপিএলে এখন পর্যন্ত কোন ম্যাচে খেলতে পারেনি তো কি হয়েছে, তিনি তো বিশ্বের সেরা সেরা সব খেলোয়াড়ের সাথে ড্রেসিংরুম শেয়ার করতে পারছেন, তাদের সাথে একই সাথে প্রাকটিস করার সুযোগ পাচ্ছে্ন।

হ্যাঁ, এসব কথার প্রতিটিই সঠিক। কিন্তু যারা এগুলো বলে বা ভেবে সান্ত্বনা খুঁজছেন, তারা ভুলে যাবেন না যে আমরা যাকে নিয়ে কথা বলছি তিনি সাকিব আল হাসান – বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার! সাকিব যদি খেলোয়াড় হিসেবে মাঝারিমানের কেউ হতেন বা বয়সে একদমই তরুণ কেউ হতেন, সেক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের সাথে ড্রেসিংরুম শেয়ার করতে পারাটা তার জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারত। কিন্তু সাকিব নিজেই একজন বিশ্বমানের খেলোয়াড়। তার সাথে খেলা বা ড্রেসিংরুম শেয়ার করাটাই বরং বিশ্বের অধিকাংশ খেলোয়াড়ের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আর তাই, সাকিব বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাচ্ছে বলে তার ম্যাচে না খেলার বিষয়টা ভুলে যাওয়া যায় না।

পাশাপাশি যদি কথা বলা হয় প্রাকটিসের মধ্যে থাকার বিষয়টি নিয়ে। হ্যাঁ, এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে কলকাতা দলে রয়েছে দারুণ কিছু কোচিং স্টাফ। তাদের অধীনে প্রাকটিস করতে পারাটা অবশ্যই একটি দারুণ ব্যাপার। কিন্তু এক্ষেত্রেও ফিরে যেতে হয় সেই আগের প্রসঙ্গেই। সাকিব কোন উদীয়মান খেলোয়াড় নন যে বিশ্বের নামিদামি কোচদের অধীনে প্রাকটিস করা তার জন্য খুব কল্যাণকর কিছু বয়ে আনবে। বিষয়টা এমনও নয় যে সাকিব তাদের কাছ থেকে নতুন কিছু শিখতে পারবেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের বয়স এক দশকের বেশি হয়ে গেছে। এখন আর সাকিবের নতুন করে কিছু শেখার নেই। পারফরম্যান্স ধরে রাখা বা নিজের অস্ত্রে ধার দেয়ার বিষয়গুলো আছে অবশ্যই, কিন্তু সেগুলো হতে পারে কেবল সত্যিকারের ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা থেকেই। স্রেফ প্রাকটিসের মধ্যে থাকায় সাকিবের বিন্দুমাত্র লাভ হচ্ছে না।

তাছাড়া ভুলে যাবেন না, আইপিএল হল ২০ ওভার ফরম্যাটের টুর্নামেন্ট। প্রাকটিস সেশনগুলোতে ২০ ওভারের ম্যাচকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন নকশা, পরিকল্পনা সাজানো হয়। সরাসরি ম্যাচে অংশ নেয়ার বদলে,শুধু সেই পরিকল্পনাগুলো দূর থেকে দেখেশুনে যাওয়ায় কোন লাভ নেই। তারচেয়ে বরং সাকিব যদি ডিপিএলে কয়েকটি ৫০ ওভারের ম্যাচ খেলতেন, সেটা তার ত্রিদেশীয় সিরিজ ও চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রস্তুতিতে ঢের সহায়ক হতো।

এ তো গেল সাকিবের প্রসঙ্গ। এবার আসুন মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে কিছু বলা যাক। এবারের আইপিএল সাকিবের যতটা ক্ষতি করছে, তারচেয়ে হাজারগুণে বেশি সর্বনাশ করে দিচ্ছে মুস্তাফিজের। মনে করে দেখুন, ২০১৫ সালে জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই মুস্তাফিজ দলের অটোমেটিক চয়েজ, তা সেটা তিনি জাতীয় দলের হয়েই খেলুন, কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেট, বা আইপিএল, বা কাউন্টি ক্রিকেটে। ম্যাচ খেলার মত ফিট ছিলেন, অথচ তারপরও ফর্মহীনতার কারণে দলের একাদশে তার জায়গা হচ্ছে না, এরকম অভিজ্ঞতা আগে কখনোই হয়নি মুস্তাফিজের। কিন্তু এবার আইপিএল খেলতে গিয়ে সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদই নিলেন মুস্তাফিজ।

মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে ম্যাচে বল হাতে বেশ খরুচে ছিলেন তিনি। ২.৪ ওভার বল করে রান দিয়েছিলেন ৩৪। আর সেজন্য পরের দুই ম্যাচেই তাকে বসিয়ে রাখা হলো। এবং এর মাধ্যমে মুস্তাফিজকে এটিও বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয়া হলো, তিনি আর দলের জন্য অটোমেটিক চয়েজ না। এই বিষয়টিকে আপাতদৃষ্টিতে নেহাতই সাদামাটা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে যে মুস্তাফিজের কনফিডেন্স লেভেলকে টেনে মাটিতে নামিয়ে আনা হলো, সেটা কি বুঝতে পারছেন? তারচেয়েও বেশি আশংকার কথা, মুস্তাফিজ শারীরিকভাবে যেমন নড়বড়ে, তেমনি মানসিকভাবেও খুব শক্তপোক্ত কেউ নন। তাই তার আত্মবিশ্বাসে এই যে একটা চিড় ধরল,
এর ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় যদি তিনি আসন্ন দুইটি মিশনে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিয়ে নিজের সেরাটা দিতে ব্যর্থ হন?

এরচেয়ে কি ভালো ছিল না মুস্তাফিজকে দেশে রেখে দিয়ে, ডিপিএলে একটি বা দুইটি ম্যাচ খেলিয়ে বাকিগুলোতে বিশ্রাম দিলে? মাশরাফি বিন মর্তুজা আসলেই মুস্তাফিজকে এবার আইপিএলে না খেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু মুস্তাফিজ যদি নিজেই নিজের ভালোটা বুঝে এবার আইপিএলে যাওয়া থেকে বিরত থাকতেন তবে সেটা তার, এবং বাংলাদেশ দল, উভয়ের জন্যই অনেক বেশি ভালো হতো।

 যাইহোক, বিসিবির বড়কর্তাদের মুখ থেকে এখন পর্যন্ত যা শোনা গিয়েছে তাতে বেশ স্পষ্ট যে সাকিব-মুস্তাফিজকে হয়ত সাসেক্সে কন্ডিশনিং ক্যাম্পে দেখা যাবে না। আইপিএলে ‘ব্যস্ত’ থাকবেন বলে কন্ডিশনিং ক্যাম্পে তাদের উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা মওকুফ করে দিয়েছে বিসিবি। কিন্তু যেহেতু সাকিব-মুস্তাফিজ আইপিএলে ম্যাচ খেলার সুযোগই পাচ্ছেন না, তাই বোধহয় সময় এসেছে বিসিবির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার।
ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ডের কন্ডিশন উপমহাদেশের তুলনায় একেবারেই আলাদা। এবং এরকম কন্ডিশনে সাকিব-মুস্তাফিজরাও সচরাচর খেলার সুযোগ পান না। তাই মুশফিক-তামিম-মাশরাফিদের যেমন এ কন্ডিশনে মানিয়ে নেয়া কঠিন হবে, সেই একই কথা প্রযোজ্য সাকিব-মুশফিকদের বেলায়ও। তাই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের প্রতি অনুরোধ, আপনি কি দয়া করে এই বিষয়টি একটু বিবেচনা করে দেখবেন? সাকিব-মুস্তাফিজরা খামোকা আইপিএলে দলের বেঞ্চ গরম না করে যদি জাতীয় দলের অন্যদের সাথে সাসেক্সে কন্ডিশনিং ক্যাম্পে যোগ দেয়, সেটাই কি বাংলাদেশ দলের জন্য মঙ্গলজনক হবে না?

0 Comment "সাকিব-মুস্তাফিজের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিবে বিসিবি ?"

Post a Comment